পুরোনো ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবন্দি অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে আবার ফিরিয়ে নেয়া হয়। তবে হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে শনিবার দিনভর নানা নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে।
শনিবার সকাল সোয়া ১১টার দিকে থেকে কারাগার থেকে বের করা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনকে। এই উপলক্ষে পুরোনো ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল পর্যন্ত নেয়া হয় নজিরবিীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
এরমধ্যে শাহবাগে খালেদা জিয়াকে বহনকারী গাড়িবহরে পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেঙে হাসপাতালের গেটে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে যোগ দেয় নেতাকর্মীরা। এসময় স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তোলে বিএনপি নেতাকর্মীরা। সঙ্গে সঙ্গেই লাঠিচার্জ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক লাঠিচার্জে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় নেতাকর্মীরা। এসময় বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়। তাদের শাহবাগ থানায় নিয়ে যেতে দেখা গেছে।
এর আগে খালেদা জিয়ার পুত্রবধু শর্মিলা রহমান ও নাতনী জাফিয়া রহমান হাসপাতালে আসেন খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাতের জন্য। কিন্তু তাদেরকে দেখা করতে দেয়নি পুলিশ। এমনকি খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া ও মাহবুবউদ্দিন খোকন পুলিশকে অনুরোধ করেন। খালেদা জিয়ার সাথে যেন প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী-সন্তানদের সাথে যেন দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশ জানিয়েছে, কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কাউকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়ার সুযোগ নেই। তারা অপেক্ষা করছেন। কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলে তাদের দেখা করতে দেওয়া হবে। তবে সাক্ষাৎ আর হয়নি।
এদিকে খালেদা জিয়া কারাগার থেকে সরাসরি এই হাসপাতালে পৌঁছলে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা থাকলেও খালেদা জিয়া পায়ে হেঁটেই হাসপাতালে প্রবেশ করেন। কারা কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার জন্য বিএসএমএমইউতে ভিআইপি কেবিন ব্লকের ৫১২ নম্বর কেবিন প্রস্তুত করা হয়েছিল। হাসপাতালে আনার পর সেখানেই তাকে রাখা হয়েছিল।
সেখানে তার জন্য গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের পাঁচ জন সদস্যও উপস্থিত ছিলেন। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য ৪ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এ বোর্ডে রয়েছেন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. মামুনও। অন্য তিনজন হলেন ডা. ফয়জুর রহমান, ডা. এম আলী ও ডা. এফ এম সিদ্দিক। আলাপ-আলোচনা শেষে তার রক্তের নমুনা নেওয়া হয় পরীক্ষার জন্য। কেবিন ব্লকের প্যথলজি বিভাগে রক্ত পরীক্ষা করা হয়। তার এক্সরেও করা হয়েছে। কেবিন ব্লকের পাশে রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে নিয়ে তার এক্সরে করানো হয়। রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের ১/এ নম্বর রুমে এক্সরে করা হয়।
এদিকে কড়া নিরাপত্তা মধ্যে মামুন নামের এক রোগী পুলিশকে বলছিলেন, ভাই, আমাকে যেতে দিন। ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের ডাক্তার ১১:৩৫ মিনিটে টাইম দিয়েছেন। চার তলার সিড়িতে দাঁড়ানো পুলিশ পান চিবুতে চিবুতে হেসে বলেন, আপনি যেই হন, এখন যেতে পারবেন না। ওই রোগী বলেন, ৩ তারিখে আজকের ডেট পেয়েছিলাম। বেগম খালেদা জিয়া আসায় যেতে দিচ্ছে না। মামুনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন চারজন ডাক্তার, নার্স। পুলিশ পথ আগলে বলেন, উপরের নিষেধ আছে, কেউ যেতে পারবেনা। এ সময় বেগম খালেদা জিয়া ৫১২ নম্বর কেবিনে চার সদস্যের মেডিকেল বোর্ড তার চেকআপ করছিলেন। এ কারনে গোটা কেবিন ব্লক মিনি জেলে পরিণত হয়। রোগীর স্বজনদের কেবিন ব্লকের প্রবেশ পথ থেকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।
কেবিন ব্লকের নীচতলার দুপুর ১২টা ৩৮ মিনিটে হঠাৎ পুলিশ সদস্যরা তৎপর হয়ে ওঠেন। ভেতরে তাকাতেই দেখা যায় ক্রিমকালারের মধ্যে কালো প্রিন্টের জামদানি শাড়ি পরিহিতা বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া হেঁটে আসছেন। তার হাত ধরে আছেন দু’জন মহিলা কারারক্ষী। সঙ্গে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালকসহ একাধিক ডাক্তার-নার্স। বিএনপি প্রধান স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে আসছিলেন। বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এরপর দুপুর দেড়টার দিকে টানা দুই মাস পর মুক্ত বাতাসে বের হয়ে বিএসএমএমইউতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর কারাগারে ফেরত যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
বেলা পৌনে ২টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মিল্টন হলে সাংবাদিকদের বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আবদুল্লাহ আল হারুন বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার হাড়ের বিভিন্ন অংশে এক্স-রে করা হয়েছে। আগামীকাল রিপোর্ট পাওয়া যাবে। রিপোর্ট পেলে বিস্তারিত জানানো যাবে। তবে আপাতত দৃষ্টিতে মনে হয়েছে তিনি ভালো আছেন।
এদিকে বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদ বলেছেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো অবনতি হলে এর দায় সরকারকে নিতে হবে। তাঁকে কারাগারে যেভাবে রাখা হয়েছে তাতে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ করেন মওদুদ। হাসপাতালের সামনে বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় নেতা মওদুদ আহমদ ও মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ শতাধিক কর্মীকে দেখা যায়। সেখানেই মওদুদ সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
মওদুদ আরো বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ভার সরকারে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাঁকে মুক্ত দিলে তিনি নিজেই নিজের চিকৎসা করাতে পারবেন। তিনি যে সত্যিকারের অসুস্থ আজকের এ অবস্থায় তা প্রমাণিত হয়েছে। তাঁকে হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হবে, কেননা তাঁর হাঁটুতে ব্যাথা। কী কারনে তাঁর পরীক্ষা করা হচ্ছে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানেন না উল্লেখ করে তিনি অনতিবিলম্বে খালেদা জিয়া মুক্তি দাবি করেন।
এছাড়া বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেছেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুতভাবে জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তার অভিযোগ, চিকিৎসার নামে সরকার খালেদা জিয়াকে মানুষিক ও শারিরিকভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য নাটক করেছে।