জলাবদ্ধতার ভয়াবহতা দেখে ২০১৭ সালে তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘আমি প্রমিজ (অঙ্গীকার) করছি, সামনের বছর থেকে আর জলাবদ্ধতা দেখবেন না।’
মন্ত্রীর (সাবেক) এ ঘোষণার পর ছয় বছর পেরিয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে এসেছেন নতুন মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। ঢাকা ওয়াসার হাত ঘুরে জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব গেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাছে। খাল খনন ও নর্দমা নির্মাণে দুই সিটি করপোরেশন শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা থেকে ঢাকাবাসী মুক্তি পায়নি।
বরং জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে ঢাকার মেয়ররা সাফল্যের দাবি করছেন। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস পুরান ঢাকার ওয়ারীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘চলতি বছর বর্ষায় অতিবৃষ্টি হলেও ১৫ মিনিটের মধ্যে পানি নিষ্কাশন হবে।’
সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিকল্পিতভাবে দক্ষ জনবল নিয়ে তিল পরিমাণ কাজ করেনি। অথচ তারা মুখে বড় বড় কথা বলে।
স্থপতি ইকবাল হাবিব, নগরায়ণ ও সুশাসন-সংক্রান্ত উপকমিটির যুগ্ম সম্পাদক, বাপা
পুরান ঢাকার বংশালে ১৪ জুন আরেক অনুষ্ঠানে মেয়র তাপস দাবি করেন, ‘সময়োপযোগী পদক্ষেপের’ কারণে দক্ষিণ সিটির আওতাধীন এলাকার জলাবদ্ধতা ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। যে বংশাল এলাকায় দাঁড়িয়ে তিনি এ দাবি করেন, তিন বছর ধরে সেই এলাকার মানুষকে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
বংশালে গত বৃহস্পতিবার রাতের বৃষ্টির পানি গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায়ও পুরোটা সরেনি। সড়কের একাংশ ছিল পানির নিচে। শুধু বংশাল নয়, পুরান ঢাকার নর্থসাউথ রোড, কাজী আলাউদ্দিন রোড, আগা সাদেক খান রোড, সিক্কাটুলি পার্কের সামনের সড়ক, নিউমার্কেট, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কয়েকটি হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলসহ বেশ কিছু এলাকার পানি ১৫ ঘণ্টায়ও পুরোটা সরেনি।
নিউমার্কেটে গতকাল সন্ধ্যায় নালা পরিষ্কারের যন্ত্র সাকার মেশিন এনে পানি সরানোর কাজ শুরু হয়। তবে ব্যবসায়ীরা সারা দিন দোকান খুলতে পারেননি। শুক্রবার ছুটির দিনের কেনাবেচা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন।
ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতা হতে পারে। কিন্তু তাই বলে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পরও পানি নামবে না, এটা কেমন কথা? এ ব্যর্থতার জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের শাস্তি হওয়া উচিত।’
নগরবিদেরা বলছেন, দুই সিটি যা করছে, তা ‘টোটকা’ ব্যবস্থা। জলাবদ্ধতার ভোগান্তি কমাতে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব সুস্পষ্ট। প্রকৃতিকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু টাকা খরচ করা হচ্ছে।
দায়িত্বের হাতবদল, পরিস্থিতির উন্নতি কম
রাজধানীতে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ১২২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এটা এ মৌসুমে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। তবে এমন বৃষ্টি প্রায় প্রতিবছরই হয়। যেমন গত বছর ২৫ অক্টোবর ঢাকায় পুরো দিনে ২৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল।
এবারের বৃষ্টির একটি দিক হলো, এটি হয়েছে ৬ ঘণ্টায়। এতে রাজধানীতে ব্যাপক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। রাজধানীর অনেক সড়ক ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলাবদ্ধ থাকে। পানি এত বেশি ছিল অনেক সড়কে যানবাহন বিকল হয়ে পড়েছিল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বৃষ্টি বেশি হলে পানি জমতে পারে। কিন্তু নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা থাকলে সেই পানি দ্রুত সরে যাওয়ার কথা। কিন্তু পানিনিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা নেই।
২০২১ সালের আগে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। তখন বৃষ্টির পানিতে রাস্তা ডুবে গেলে সিটি করপোরেশন ঢাকা ওয়াসার ওপর দায় চাপাত। যেমন ২০২০ সালের জুলাই মাসে নগরের জলাবদ্ধতা চিত্র সরেজমিনে দেখতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম।
আরও পড়ুনদুর্ভোগের এক রাত পার করল ঢাকাবাসী
ওই দিন নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ওয়াসা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)। কিন্তু তারা এটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘রাস্তায় পানি জমলে গালি আমাদের শুনতে হয়।’
এরপর ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসা আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) দিয়েছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে। কিন্তু অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় জলাবদ্ধতা তুলনামূলক কম হয়। দক্ষিণ সিটির কিছু এলাকায় বৃষ্টি হলেই সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র যে অনুষ্ঠানে ১৫ মিনিটের মধ্যে পানি সরে যাওয়ার কথা বলেছিলেন সেখানে উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মিজানুর রহমান। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৫ মিনিটে পানি সরে যাওয়ার কথা কে বলেছেন আমি তা জানি না।’ জলাবদ্ধতার বিষয়ে তিনি সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুনছবিতে দেখুন দুর্ভোগের রাতের পর সকালের ঢাকা
পানি জমলেই প্রকল্প
ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, যে স্থানে পানি জমে জলাবদ্ধতা হয়, সেখানেই পানি সরাতে প্রকল্প নেওয়া হয়। এভাবে গত তিন বছরে পানি জমে থাকে, এমন ১৩৬টি স্থানকে চিহ্নিত করা হয়। সেসব স্থানে নর্দমাসহ অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ১০৩টি স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এ কাজে সংস্থাটির ব্যয় হয়েছে ২২৫ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন করতে চাইলে পানি যেসব পথ হয়ে নামে, সেখান থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। কিন্তু এভাবে কাজ হচ্ছে না। তিনি বলেন, পুরান ঢাকার বৃষ্টির পানি বাবুবাজার দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচ দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ে। বহু আগে নির্মিত নালাটি সরু। সিটি করপোরেশন গুরুত্বপূর্ণ এই পানিনিষ্কাশন নালা সংস্কার না করে ভেতরের এলাকায় নর্দমা সংস্কার করেছে। এতে পানি ঠিকভাবে আর নামতে পারছে না।
পানি জমলেই প্রকল্প—এই ধারায় চললেও নিউমার্কেট এলাকার পানি সরাতে গত এক যুগেও কোনো পরিকল্পনা নেয়নি ঢাকা দক্ষিণ সিটি। সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আগে নিউমার্কেট ও এর আশপাশের এলাকার পানি পিলখানার ৩ নম্বর ফটক (আজিমপুর-নিউ পল্টন লেন) এলাকার নালা হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়ত। ২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর ওই পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বিকল্প কোনো পথ এক যুগের বেশি সময়েও বের করতে পারেনি দক্ষিণ সিটি। ফলে নিউমার্কেট এলাকার পানি দ্রুত সময়ে সরানো যাচ্ছে না।
নিউমার্কেট এলাকার পানি সরাতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কেন, জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ সিটির একজন প্রকৌশলী গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ওই এলাকার পানি সরাতে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নিউমার্কেট এলাকার পানি কালুনগর খাল হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়বে। কাজটি আগামী বর্ষার আগে শেষ হবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি।
আরও পড়ুনমা–বাবাহারা শিশুটি বেঁচে আছে, হাসপাতালে নিয়েছিলেন দুই হিজড়া
খরচ চলছে, জলাবদ্ধতাও থাকছে
ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, গত এক যুগে জলাবদ্ধতা নিরসনে কমপক্ষে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব পাওয়ার পর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন তিন অর্থবছরে ব্যয় করেছে অন্তত ৭০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরেও দুই সিটি করপোরেশনের ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা আছে।
নগরবিদেরা বলছেন, দুই সিটি যা করছে, তা ‘টোটকা’ ব্যবস্থা। জলাবদ্ধতার ভোগান্তি কমাতে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব সুস্পষ্ট। প্রকৃতিকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু টাকা খরচ করা হচ্ছে।
দুই সিটির প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা এবং নগরবিদেরা বলছেন, বৃষ্টির পানি নর্দমা হয়ে খালের মাধ্যমে নদীতে যাওয়া পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে। প্রথমে বৃষ্টির পানি ক্যাচপিটের (নালার ওপরের ছিদ্রযুক্ত ঢাকনা) মাধ্যমে সড়কের নিচে পানিনিষ্কাশনের নালায় যায়। বিভিন্ন সড়কে সিটি করপোরেশনের আওতায় সড়ক ও ফুটপাত সংস্কারকাজের কারণে বহু ক্যাচপিট এবং নালার মুখ বন্ধ গেছে। পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতলসহ নানা বর্জ্য এবং বালু জমেও নালার মুখ বন্ধ হয়ে থাকে।
বৃষ্টির পানি সড়কের নিচের অংশের নালা হয়ে খাল ও নদীতে গিয়ে পড়ে। সেই নালার অবস্থা করুণ। খালের তলায় মাটি জমে গভীরতা কমে যাওয়ায় পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে।
নগরবিদেরা বলছেন, শহরের মোট ভূমির কমপক্ষে ১২ শতাংশ জলাধার থাকা দরকার। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র ২ শতাংশ। ফলে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জায়গা নেই।
জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে ঢাকার মেয়ররা প্রহসন করেছেন বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নগরায়ণ ও সুশাসন-সংক্রান্ত উপকমিটির যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিকল্পিতভাবে দক্ষ জনবল নিয়ে তিল পরিমাণ কাজ করেনি। অথচ তারা মুখে বড় বড় কথা বলে।
আরও পড়ুনঢাকায় রাতে প্রবল বৃষ্টি, প্রচণ্ড দুর্ভোগ, চারজনের প্রাণহানি
জলাবদ্ধতায় ক্ষতি, জলাবদ্ধতায় মৃত্যু
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জনশুমারির (২০২২) প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, রাজধানী ঢাকায় ১ কোটি ২ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। জলাবদ্ধতা মানুষের জীবনে নানাভাবে দুর্ভোগ তৈরি করে। চলাচলের ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। জলাবদ্ধতা অর্থনীতির ক্ষতি করে। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘জলবায়ু ও দুর্যোগসহিষ্ণু বৃহত্তর ঢাকা এলাকা: একটি ব্যষ্টিক বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরে জলাবদ্ধতার কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ গড়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা, এখন যা আরও বেশি।
কোনো কোনো সময় মানুষের মৃত্যুর কারণ হয় জমে থাকা পানি। ২০১৯ সালের আগস্টে গ্রিনরোডে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান তরুণ চিকিৎসক পলাশ দে। এবার গত বৃহস্পতিবার রাতে মিরপুরে মারা গেছেন চারজন মিজান হাওলাদার (৩৫), তাঁর স্ত্রী মুক্তা (২৫) ও মেয়ে লিমা (৭)। মিজানের সাত মাসের শিশুসন্তান হোসাইনকে বাঁচাতে গিয়ে মারা যান স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ অনীক (১৮)।
শিশুটির দাদা নাসির হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এতটুকু বয়সেই নাতি এতিম হলো।’