তানভীর দিপু।।
অবকাঠামো সংকটে ধুঁকছে কুমিল্লা জেলার অন্যতম সরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল। যা কুমিল্লা সদর হাসপাতাল নামে বেশি পরিচিত। শতবর্ষী এই হাসপাতালে রোগীদের যেমন রয়েছে নানান অসুবিধা, তেমনি চিকিৎসকদেরও নেই চিকিৎসা দেবার সুষ্ঠু পরিবেশ। জেলা সিভিল সার্জন জানালেন, হাসপাতালটি আড়াইশো শয্যা করার জনবল চাওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ে।
কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, ১৮৪৫ সালের প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা চেরিটেবল ডিসপেনসারি বাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৮৭১ সালের দিকে কুমিল্লা দাতব্য চিকিৎসালয়ের নামে প্রতিষ্ঠানটিতে হাসপাতাল কার্যক্রম শুরু করে রোগী ভর্তি শুরু করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর ৫০ শয্যা হাসপাতালে পরিণত হয় প্রতিষ্ঠানটি । যা বর্তমানে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল বা সদর হাসপাতাল নামে পরিচিত। সরকারি পাঁচ টাকা টিকেটে হাসপাতালটিতে বহির্বিভাগ ও সরকারি খরচে আন্ত বিভাগ চালু রয়েছে। তবে বর্তমানে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগেই রোগী হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয় ৩ লাখ ৩৯ হাজার মানুষ, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৩ লাখ। এবছর ২০২৫ সালে গত সাত মাসে এই জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ।
প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে বহির্বিভাগেও চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর প্রয়োজনে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো হলেও – চিকিৎসা দেবার কক্ষ সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। সরকারি ৩৩ জন এবং অবৈতনিক ১৬ জন- সর্বমোট ৪৯ জন চিকিৎসকের জন্য রয়েছে মাত্র ১৯ টি কক্ষ। ঔষধ বিতরনের জন্য দুইটি কক্ষ আর বিশ্রামে জন্য কংক্রিটের আসন করা টিন শেড রয়েছে। সেখানেই দুইটি কাউন্টার থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেনা হয়। বর্তমানে বহির্বিভাগে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনী, অর্থোপেডিক্স, নাক- কান- গলা, চক্ষু, চর্ম ও যৌন, ফিজিক্যাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসা দেয়া হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের পেছনের দিকে টিনশেড ভবনে মেডিসিন বিভাগের দুই কক্ষে ৯ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন। যেখানে রোগী বসার জায়গা পর্যন্ত নেই। বাইরে রোগীর লম্বা লাইন টিনের ছাউনি পার হয়ে খোলা আকাশের নিচে চলে গেছে। রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করেই রোগীরা অপেক্ষা করেন সেখানে।
সামনের দিকে পুরোনো ভবনের চিকিৎসকদের কোন কোন কক্ষে নেই রোগী শোবার বিছানাও। চেয়ার টেবিলগুলোও যেন বয়সের ভারে রঙচটা হয়ে গেছে। পুরোনো স্যাতস্যাতে ভবনের কক্ষগুলোতে আলোর অভাব। প্রাথমিক চিকিৎসায় নেই উন্নত- যন্ত্রপাতি। বিশ্রামের জায়গা না থাকায়, গাছের নিচে- পুকুর পাড়ে অপেক্ষা করতে হয় রোগী ও স্বজনদের। বেশি অসুস্থদের অপেক্ষা করতে হয় মেঝেতে বসে, অটোরিকশা কিংবা সিএনজিতে বসে। সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েন যারা বৃদ্ধ কিংবা শিশু। বৃষ্টি, প্রচন্ড রোদে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষায় যেন আর অসুস্থ হয়ে পড়েন রোগীরা।
মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক মোঃ আল মামুন জানান, কিছুই করার নাই। আমরা দুই রুমে ৯ জন চিকিৎসক বসি। এই রুমগুলোতে মানুষ দাঁড়ানোরও জায়গা নাই। তার উপর এখানে নার্সদেরও বসার জায়গা দিতে হচ্ছে। এটা সেবা দেয়ার কোন পরিবেশ না? মনযোগ দিয়ে রোগী দেখা কষ্টকর।
ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. মোঃ রাসেল খান বলেন, প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি খরচে মানুষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে সেবা নিতে পারছে। বিনামূল্যে অপারেশন হচ্ছে, বিনামূল্যে ঔষধ পাওয়া যাচ্ছে। শুধুমাত্র অবকাঠামগত উন্নয়ন করা হলে, আরো বেশি চিকিৎসক ও বিভিন্ন রোগের আলাদা আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবত। এই প্রতিষ্ঠানটি কুমিল্লার মানুষের স্বাস্থ্য সেবার সকল আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারতো। তারপরও মানুষ আসে, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি।
বহির্বিভাগে অপেক্ষারতদের রোদ বৃষ্টিতে চরম ভোগান্তিঃ
সম্প্রতি কুমিল্লা হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে গিয়ে কথা হয় নাঙ্গলকোট উপজেলা থেকে আসা জুলেখা বেগমের সাথে। তার মা ৮০ বছর বয়সী সাফিয়া বেগমকে নিয়ে এসেছেন থেরাপি দিতে। জুলেখা জানান, সকাল ৭ টায় ব্রেনস্ট্রোকে আক্রান্ত মা’কে নিয়ে এসে বারান্দায় অপেক্ষা করছি। সকাল সাড়ে ১০ টায় সময় পেয়েছি। এই সময়টা প্রচন্ড গরমের মধ্যে সিমেন্টের চেয়ারে বসে আছি। মায়ের দুই হাত পা অবশ, এভাবে কষ্ট করে কতক্ষণ বসে থাকা যায়।
সবচেয়ে লম্বা রোগীর সারি হয় চর্ম ও যৌন বিভাগে? এ বিভাগের চিকিৎসকের কাছে আসা মহিবুল আলমের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আমার বাবা বয়স্ক মানুষ চর্ম রোগে আক্রান্ত। উনি পুকুর পাড়ে বসে অপেক্ষা করছে, আমি সিরিয়ালের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি এসেছিল, বৃষ্টিতে ভিজেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এখানে ডাক্তার ভালো, সেবাও ভালো – কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি।
শিশু বিভাগের সামনে এক বছর বয়সী বাচ্চাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সামিনা আহমেদ বলেন, গরমে শিশুদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। আর ছাউনির নিচে এখানে কোন ফ্যান নেই। অনেক শিশুর বয়স অনেক কম, তাদের জন্য একটু ঠান্ডা পরিবেশও দরকার হয়। বয়স্কদেরও কষ্ট হয় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে।
স্থাপনার অভাবে অপ্রতুল চিকিৎসক! :
গত ১০ আগষ্ট হাসপাতালের বহির্বিভাগে টিকিট কেটেছেন ১ হাজার ৭ শ ৩৯ জন। তার বিপরীতে সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছেন চিকিৎসকরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, যে পরিমাণ রোগী আসে প্রতিদিন তার জন্য যে চিকিৎসক তা খুবই অপ্রতুল। কারণ কোন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীকে সময় দিয়ে – চিকিৎসা সেবা দিতে হলে অন্যান্য রোগীরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। যে কারণে একটি বিভাগে অন্তত পাঁচজন চিকিৎসক থাকলে কোনরকমে চাপ সামলে নেয়া যায়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, চর্ম রোগের বিভাগে প্রতিদিন গড়ে চার শত রোগী হয়। কিন্তু এই বিভাগে চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র তিনজন, তাও তারা আবার সংযুক্তিতে রয়েছেন। এই পরিমাণ রোগীর জন্য প্রতিদিন অন্তত ছয় থেকে আট জন চিকিৎসকের প্রয়োজন।
মেডিসিন বিভাগে গড়ে ৪ শত জন রোগীর জন্য রয়েছে- পদায়নকৃত মাত্র তিনজন চিকিৎসক, বাকি যে কয়েকজন আছে তারা রয়েছেন সংযুক্তিতে। মেডিসিনের জন্যই পদায়নকৃত অন্তত ৬জন চিকিৎসক প্রয়োজন। শিশু বিভাগে রয়েছেন মাত্র দুইজন পদায়নকৃত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যেখানে গড়ে রোগী হয় প্রতিদিন আড়াই শ’ জন। এই বিভাগে অন্তত পাঁচ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজন।
চিকিৎসা নিতে আসা বহির্বিভাগের একাধিক রোগী জানালেন, চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ালে রোগীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। সাধারণ মানুষের সেবার মান আরো বাড়বে। কিন্তু চিকিৎসক আসলে তারা বসবেন কোথায়? – এই প্রশ্ন রোগীদেরও। যেখানে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের আলাদা আলাদা সাজানোগুছানো কক্ষ থাকে, সে তুলনায় এখানের পরিবেশ গণরুমের মত।
কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার আব্দুল করিম খন্দকার জানান, রোগীর সংখ্যা বাড়ছে মানে সেবার মান বাড়ছে। হাসপাতালটার স্থাপনা খুবই দুর্বল। চাইলেও আমরা বেশি ডাক্তার দিতে পারছি না। কাউন্টারে ভিড় কমাতে আরো কাউন্টার করলেও লাভ নাই, কারন ডাক্তার নাই। যে জায়গায় একজন ডাক্তার সেবা দেবার কথা সেখানে দুই তিনজন বসে – এটা শুধু স্থাপনার কারনে। যখন হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত হবে তখন এসব সমস্যা কমে আসবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতামত ঃ
দিন দিন চিকিৎসা সেবার খরচ বাড়তে থাকায় – এখন সরকারি হাসপাতাল মুখী হচ্ছেন মধ্যবিত্তরাও। তাই আগের তুলনায় সরকারি চিকিৎসকের কাছে সেবা নিতে আসার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানালেন কুমিল্লার প্রবীণ চিকিৎসক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ইকবাল আনোয়ার। কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসকদের সেবা দানের পরিবেশ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, একজন চিকিৎসককে তার কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। একজন অসুস্থ মানুষকে যেন তিনি মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করতে পারেন সেজন্য তাকে সময়ও দিতে হবে। কিন্তু কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালে যেভাবে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বহির্বিভাগে সেজন্য চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। না হয় চিকিৎসকরা মনোযোগ হারিয়ে ফেলতে পারেন।
ডা. ইকবাল আনোয়ার আরো বলেন, কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল কুমিল্লা শহরের অন্যতম সরকারি চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র। শুধু শহরের নয়, বিভিন্ন উপজেলা থেকেও রোগীরা আসেন এখানে চিকিৎসা নিতে। আমাদের দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগীদের কথা বিবেচনায়ও খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে অবকাঠামগত উন্নয়ন করতে হবে। না হয় ও চিকিৎসা নিতে আসা অসুস্থ লোকজন আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। যেটা আমরা একজন চিকিৎসক হিসেবে মেনে নিতে পারি না।
এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীদের জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, এমন গাদাগাদি পরিবেশে যা কখনোই সম্ভব নয় বলেও মন্তুব্য করেন তিনি।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের বক্তব্যঃ
কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ও কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক আলী নূর মোহাম্মদ বশির জানান, ১৬৫ বছর বয়সী হাসপাতালটিতে ক্যাম্পাসে ৫ একর জায়গা রয়েছে। হাসপাতালটিকে ২৫০ শয্যা হাসপাতালে উন্নীত করনের জন্য আবেদন করা হয়েছে মন্ত্রণালয়। যত দ্রুত এই প্রকল্প অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন হবে কুমিল্লার মানুষ তত ভালো সেবা পাবেন।
একই রুমে একাধিক চিকিৎসক বিষয়টি মেনে নেয়া যায় না মন্তব্য করে সিভিল সার্জন বলেন, আমাদের আসলেই কিছু করার নেই। প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার রোগীর চাপ সামলাতে আমাদের একই রুমে দুইজন বা তিনজন চিকিৎসক বসতে হচ্ছে।


