Sunday, March 9, 2025
Google search engine
Homeতথ্য ও প্রযুক্তিস্টারলিংকের ইন্টারনেটে স্বাধীনতা নাকি নিয়ন্ত্রণ

স্টারলিংকের ইন্টারনেটে স্বাধীনতা নাকি নিয়ন্ত্রণ

বাংলাদেশে স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক চালুর বিষয়ে আগ্রহী অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের ভাষ্য, স্টারলিংক এলে ইন্টারনেট সম্পূর্ণরূপে বন্ধ (শাটডাউন) করার সুযোগ কর্তৃপক্ষের হাতে থাকবে না। যদিও স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবার খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, স্টারলিংককে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর শর্ত মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খসড়া নীতিমালা শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত হলে পরিস্থিতির খুব বেশি হেরফের হবে না। বিগত সরকারগুলোর মতোই ধনকুবের ইলন মাস্কের উচ্চগতির এ ইন্টারনেট সেবা সরকারের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে।
আর দেশের ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা (আইএসপি) স্টারলিংকের আগমনকে তাদের প্রচলিত ব্যবসার জন্য হুমকি মনে করছেন। তারা বলছেন, এতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যাবে। টাকা চলে যাবে বিদেশে। যদিও মোবাইল অপারেটররা স্টারলিংকের আগমনকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ইন্টারনেট সংযোগের কাজ করে সাবমেরিন কেবল ও ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্ট্রিয়াল কেবল (আইটিসি) অপারেটর। এ দুটি অপারেটর থেকে পাইকারি দরে ব্যান্ডউইথ কেনে দেশের ৩৪টি আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে)। এর পর আইএসপি (ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান) হয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় ইন্টারনেট সেবা। বর্তমানে ৫ হাজার ২০০ জিবিপিএস চাহিদার মধ্যে ২ হাজার ২০০ দিচ্ছে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি। ৩ হাজার জিবিপিএস ভারত থেকে আমদানি করে ছয়টি আইটিসি অপারেটর। এ ছাড়া ভি-স্যাটের মাধ্যমে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বহির্বিশ্বের সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ রক্ষা করে।
ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের স্টারলিংক প্রকল্প শুরু হয় ২০১৫ সালে। ২০১৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্টারলিংক স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়। এর ইন্টারনেট সেবা জিওস্টেশনারি (ভূস্থির উপগ্রহ) থেকে আসে। এ স্যাটেলাইটগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার ওপর থেকে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে। পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে স্থাপিত হাজার হাজার স্যাটেলাইটের সমষ্টি হচ্ছে স্টারলিংক। গত জানুয়ারি পর্যন্ত স্টারলিংক তার কক্ষপথে ৬ হাজার ৯৯৪টি স্যাটেলাইট স্থাপন করেছে। এসব স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার ওপরে কক্ষপথে ঘুরছে। প্রায় ৪২ হাজার স্যাটলাইট স্থাপনের কথা রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে স্টারলিংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভুটান প্রথম স্টারলিংকের সেবা গ্রহণ করে। স্টারলিংক ব্যবহারকারীরা গড়ে ১০০ এমবিপিএসের বেশি গতি পান, যেখানে বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গড় ডাউনলোড গতি ৪০ ও আপলোড ১৩ এমবিপিএস। আর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ডাউনলোড গতি প্রায় ৫১ ও আপলোড ৪৯ এমবিপিএস।
স্টারলিংকে বিশেষ আগ্রহের নেপথ্যে
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে স্টারলিংক নিয়ে আলোচনা চলছে। তিন বছর ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করার আগ্রহ দেখাচ্ছে ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠানটি। গত বছর জুলাইয়ে জুনাইদ আহমেদ পলক টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় স্টারলিংকের প্রযুক্তি এনে পরীক্ষা করা হয়। জুলাই আন্দোলনের পর আবার আলোচনায় আসে প্রতিষ্ঠানটি। গত অক্টোবরে স্টারলিংকের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করে। ৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্টারলিংক নিয়ে এটির প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্কের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে আলোচনা করেন।
১৯ ফেব্রুয়ারি ইলন মাস্ককে পাঠানো আনুষ্ঠানিক চিঠিতে ড. ইউনূস বাংলাদেশে স্টারলিংক চালুর কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টা তাঁকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ ও আগামী ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা চালুর প্রস্তাব দেন।
গত সোমবার এক সেমিনারে বিটিআরসি চেয়ারম্যান এমদাদ উল বারী জানান, তারা স্টারলিংকের বিষয়ে কাজ করছেন। মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও জানান, স্টারলিংক চালুর বিষয়ে উদ্যোগের মূল কারণ ইন্টারনেট শাটডাউন চিরতরে বন্ধ করা।
তবে বিশ্লেষকরা স্টারলিংককে শুধুই ইন্টারনেট সেবা হিসেবে দেখছেন না। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে ইলন মাস্কের সঙ্গে বিশেষ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতেই অন্তর্বর্তী সরকার স্টারলিংক নিয়ে আগ্রহী হয়েছে।
কী ভাবছেন দেশীয় ব্যবসায়ীরা
দেশীয় ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্টারলিংক মূলত বাংলাদেশে আইএসপি হিসেবে কাজ করবে। দেশের আইআইজি থেকেই তাকে ব্যান্ডউইথ কিনতে হবে। বড় কোম্পানি হওয়ায় স্টারলিংকের ব্যবসার সঙ্গে পেরে উঠবে না দেশীয় অনেক আইএসপি। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এক আইএসপি ও এক আইআইজি ব্যবসায়ী সমকালকে এ উদ্বেগের কথা জানান। তারা আরও বলেন, স্টারলিংক বিদেশি কোম্পানি হওয়ায় টাকা দেশের বাইরে চলে যাবে।
তবে মোবাইল অপারেটররা স্টারলিংকের আগমনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, নতুন প্রযুক্তি সব সময় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার শাহেদুল আলম বলেন, স্যাটলাইট ইন্টারনেট সেবা দেশে এলে দুর্গম এলাকায় ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানো সহজ হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খসড়া নীতিমালা অনুসারে স্টারলিংকের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতেই থাকবে। অবাধ ইন্টারনেট স্বাধীনতা সম্ভব হবে না।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, স্টারলিংক মূলত আইএসপির মতো কাজ করবে। আইআইজি থেকে ব্যান্ডউইডথ নিতে হবে। ফলে পুরো দেশে কোনো কারণে ইন্টারনেট বন্ধ করা হলে স্টারলিংকের স্যাটেলাইটেও থাকবে না। আবার দেখা যাচ্ছে, এনটিএমসির মতো প্রতিষ্ঠান স্টারলিংকেও আড়ি পাতছে।
তিনি আরও বলেন, স্টারলিংকের প্যাকেজ বেশ ব্যয়বহুল। সাধারণ গ্রাহকের পক্ষে এখনই এ সেবা কেনা সম্ভব নয়। দেশে একজন গ্রাহক ৫০০ টাকায় মাসজুড়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু স্টারলিংকের সর্বনিম্ন মাসিক খরচ পড়বে ১৫ হাজার টাকা। আবার সংযোগ পেতে যেসব যন্ত্রপাতি গ্রাহককে বসাতে হবে, তার দামও কম নয়। এ জন্য কমপক্ষে ৪৫ হাজার টাকা লাগবে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments