কুমিল্লার নাঙ্গলকোট পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুল মালেক। একসময় খাদ্যগুদামের কুলি ও ইটভাটার শ্রমিক ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে- পৌরসভার অর্থ লোপাট, সব টেন্ডারে ৩০% কমিশন, সরকারি জায়গা দখল ও উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি দুই হাতে অর্থ কামিয়েছেন। এসব করে গত ১৫ বছরে শূন্য থেকে অন্তত শতকোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের আশীর্বাদে বদলে যায় তার দুনিয়া।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নাঙ্গলকোট পৌরসভার কোদালিয়া এলাকার মোহাম্মদ আলীর ছেলে আব্দুল মালেক একসময় উপজেলা সদরের সরকারি খাদ্যগুদামে লোড-আনলোডের কাজ করতেন। পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করতে পাশাপাশি মৌসুমে ইটভাটা শ্রমিকের কাজও করতেন?। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের এ মালেকের কপাল খুলে লোটাস কামালের সান্নিধ্য পেয়ে। ২০০৪ সালে যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন মালেক। তখন তার নুন আনতে পান্তা ফুরাতো।
পরবর্তীতে উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক এবং সভাপতির পদ লাভ করেন। পাশাপাশি কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ, নাঙ্গলকোট পৌর আওয়ামী লীগ ও নাঙ্গলকোট উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মালেক। শুরু করেন সরকারি জায়গা দখল, টেন্ডারবাজি, সালিশ দরবার, তদবির বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম। ২০১৬ সালে মুস্তফা কামালের আশীর্বাদে অনেকটা বিনা ভোটেই তিনি নাঙ্গলকোট পৌরসভার মেয়রের পদ বাগিয়ে নেন। পরে ২০২১ সালে একই কায়দায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন।
মেয়রের দায়িত্ব পালনকালে পৌরসভার বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের কমিশন, উন্নয়নের নামে সরকারি ও বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ, পৌর বাজারের ইজারার টাকা ও রাজস্ব ফান্ডের অর্থ লুটপাট করেন।
পৌরসভা সূত্র জানায়, ২০১৬ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত পৌর সদরে বাস টার্মিনাল নির্মাণে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। যদিও বাস টার্মিনালের কোনো অস্তিত্ব নেই। রাস্তা আলোকিত করতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫ কোটি টাকা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ড্রেনেজ নির্মাণে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। নামকাওয়াস্তে কিছু ড্রেন নির্মাণ করা হলেও এসব ড্রেন এখন এবড়োথেবড়োভাবে পড়ে আছে। পৌরসভার সৌন্দর্য বর্ধন ও বিনোদন পার্ক নির্মাণে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। যদিও পার্কের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। পৌর সড়কে সোলার বাতি লাগানোর কথা থাকলেও পুরো পৌরসভার কোথাও সড়কে সোলার বাতি নাই।
এ ছাড়া পৌরসভার বেতাগাও সড়ক থেকে ভূঁইয়াবাড়ি পর্যন্ত ২৯০ মিটার সড়ক নির্মাণে ৩০ লাখ ৬ হাজার ৯৩২ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেখানে ৫ লাখ টাকার কাজও হয়নি। শ্রীহাস্য সোলেমানের বাড়ি থেকে ভাতড়া পাকা সড়ক পর্যন্ত ৫০০ মিটার সড়কের জন্য ৮২ লাখ ৫১ হাজার ৯০৩ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। চৌগুড়ী পাকা সড়ক হতে নাওগোদা দৌলতপুর সড়কের ২৫৭ মিটার রাস্তায় ৩৪ লাখ ৫৩ হাজার ৭০৩ টাকা, নাওগোদা রাস্তা হতে মফিজ সওদাগরের দোকান পর্যন্ত ৬৫০ মিটার রাস্তায় ৮৯ লাখ ২৪ হাজার ৮৩৩ টাকা ও কোদালিয়া ঢালুয়া সড়কের ১ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণে ৫০ লাখ ৮২ হাজার ১৭৫ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। নিজস্ব সিন্ডিকেটের ঠিকাদার দিয়ে এ রকম বহু প্রকল্পে নামকাওয়াস্তে কাজ দেখিয়ে বেশিরভাগ অর্থই লুটপাট করেছেন মেয়র মালেক।
স্থানীয়রা জানান, নাঙ্গলকোট পৌরবাজার থেকে দৌলতপুর পর্যন্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থার রডগুলো দেখা যায়। এ ড্রেনটির বিভিন্ন স্থানে কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে এখনো। নাঙ্গলকোট থেকে দাউদপুর পর্যন্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থারও বেহাল দশা।
তারা আরও জানান, মালেক নিজে লেখাপড়া তেমন না করলেও সভাপতিত্ব করেছেন একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কয়েক কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। তিনি আইটপাড়া আজিজিয়া দাখিল মাদ্রাসা, শ্রীকাম্তা দাখিল মাদ্রাসা, পানকরা দাখিল মাদ্রাসা, চাটিতলা উচ্চ বিদ্যালয় এবং শিশু নিকেতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
জানা যায়, পৌরসভার দৈয়ারা মৌজার ৫৫৩ দাগে ৫ শতক, ৪৮০ দাগে ১৮ শতক, ৫৬৫ দাগে ৩ শতক, ৫৫১ দাগে ৬ শতক, ৫৪১ খতিয়ানে ৭৭ শতকসহ মোট ১০৯ শতক জমি রয়েছে মালেকের। দুই ছেলে তানভীর মাহবুব ও তাফহীম মাহবুবের নামে পৌরসভার দৈয়ারা মৌজার ৪৪৯ দাগে ৫ শতক, ৩৩৮ দাগে ৭ শতক, ৪৪৯ দাগে ১.৫ শতক ও ৫৪৯ দাগে ৬ শতকসহ মোট ১৫ শতক জায়গা রয়েছে। নাঙ্গলকোটের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে ৫ তলা আলিসান বাড়ি। গরু বাজারের পাশে ৩ তলা মার্কেট। নাঙ্গলকোট খাদ্য গুদামের সামনে ৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন। এর দক্ষিণ পাশে স’মিল ও ২ তলা ভবন রয়েছে। বেশকিছু মূল্যবান কৃষি জমি এবং বাজারে দোকানপাটও গড়ে তোলেন মালেক। এছাড়া নাঙ্গলকোট রেলওয়ে স্টেশনের পাশে প্রায় এক বিঘা সরকারি জায়গা রয়েছে তার দখলে।
পৌর এলাকার জালাল আহমেদ বলেন, প্রতিটি প্রকল্পে দ্বিগুণ-৩ গুণ বরাদ্দ দিতেন মেয়র মালিক। পরে নিজস্ব লোকদের ঠিকাদারি লাইসেন্সে নামকাওয়াস্তে কাজ দেখিয়ে ৫০ থেকে ৬০% টাকা লুটে নিতেন। তাছাড়া অনেক প্রকল্পের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রকল্পের নাম করে তিনি টাকা লুট করেছেন।
পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নিজাম মজুমদার বলেন, প্রতি কাজে মেয়র মালেককে ৩০% করে কমিশন দিতে হতো। ১ লাখে ৩৩ হাজার টাকা কেটে নিতেন মালেক। কাজের কমিশন অগ্রিম না দিলে কাজ দেওয়া হতো না।
পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আলাউদ্দিন বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমাকে একটি কাজ দেওয়া হয়েছে। কাজের জামানত ৩ লাখ টাকা। মেয়র মালেক কমিশনসহ মোট ১১ লাখ আত্মসাৎ করেন?। তিনি কাজের টাকা তুলে নিজেই ভোগ করেন, আমাকে দেন নাই।
হেসাখাল ইউপির ৮নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার আবু জাফর মজুমদার বলেন, আমি ২০১০ সাল থেকে ইউপি সদস্য নির্বাচন করে আসছি। ২০২২ সালের নির্বাচনে মেয়র মালেক আমাকে জয়ী করিয়ে দিবে বলে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেন। কিন্তু আমাকে জয়ী করাতে পারেন নাই। পরে টাকাও ফেরত দেন নাই।
আত্মগোপনে থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে আব্দুল মালেকের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।