সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা জাহানারা বেগম ডলি (৪০) দীর্ঘ ৯ বছর ধরে কিডনি সমস্যায় ভুগছেন । নাজিরেরগাঁও বাদাঘাট রোডের কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে শনিবারে সকালে ডায়ালাইসিস করাতে আসেন তিনি। প্রতিবেদকের সঙ্গে হাসপাতালে কথা হয় । তিনি বলেন, ৪ বছর ধরে সপ্তাহে দুবার ডায়ালাইসিস করতে এই হাসপাতাল আসেন। প্রথমে একবার ডায়ালাইসিস বাবদ দেড় হাজার টাকা করে লাগত। অর্থ সংকটে টাকা কমানোর আবেদনের পর সপ্তাহে একটা করে ডায়ালাইসিস ফ্রি পান। এর মধ্যে হঠাৎ গর্ভবতী হয়ে পড়ায় গত ৭ মাস ধরে ডায়ালাইসিস, টেস্ট ও ডায়ালাইজার সেট বিনামূল্যে পাচ্ছি।
একই অবস্থা সিলেটের এয়ারপোর্ট এলাকায় মুদি দোকানি সুমির মিয়ার। দুই বছর আগে কিডনি রোগ শনাক্ত হয় তার। জটিলতা দেখা দেওয়ায় এক মাস আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর থেকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয় সুমিরের। তার স্ত্রী রানী বেগম যুগান্তরকে বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিবার ডায়ালাইসিস করতে ২ হাজার ৭০০ টাকা গুনতে হতো। স্বামীর চিকিৎসার জন্য ভিটেবাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে। এখন অন্যের জায়গায় পরিবার নিয়ে থাকি। ৩ মেয়ের মধ্যে একজনের বিয়ে দিয়েছি। দুই মেয়ে নিয়ে খুবই কষ্টে বেঁচে আছি। মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা স্বামীর চিকিৎসায় ব্যয় করতে হয়। এখন চিকিৎসা করানো টাকা নেই। আজ ডায়ালাইসিস করাতে এসে হাতের ফিস্টুলা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন নতুন করে করাতে ৮ হাজার টাকা লাগবে। এত টাকা কোথায় পাব জানি না। এই হাসপাতালে স্বল্পমূল্যে সেবা পাওয়ার জন্য এখানে আসা।
এদিকে শনিবার এক ভিডিও বার্তায় কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, এই উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি সুবিধাবঞ্চিতরা উপকৃত হচ্ছেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন-সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ, কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ, কিডনি ফাউন্ডেশন হসপিটাল সিলেটের চেয়ারম্যান ইমেরিটাস অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক ডা. মুশফিকুর রহমান প্রমুখ।
সিলেটের কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ সালে ছয়টি ডায়ালাইসিস মেশিন নিয়ে হাসপাতালটি যাত্রা শুরু হয়। রোগীদের গত সাত বছরে ৭০ হাজার ২৪১ বার সেশন ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালটি গত বছর ১৮ হাজার ৩২৪টি ডায়ালাইসিস সেশন সফলভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। কিডনি ফাউন্ডেশনের হাসপাতালে আসা ৫৫ ভাগ ডায়ালাইসিস সেশন ভর্তুকি মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ৩২টি ডায়ালাইসিস মেশিনে তিন শিফটে প্রতিদিন শতাধিক রোগীকে সেবা দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতালটি নির্বাহী পরিচালক ডা. মুশফিকুর রহমান, যুগান্তরকে বলেন, এখানে গরিব ও অসহায় রোগীরা ভর্তুকির মাধ্যমে ধাপে ধাপে ৫০০, ১০০০ ও ১৫০০ টাকা জমা দিয়ে ডায়ালাইসিস করাতে পারেন। গরিব রোগীদের ৫৬ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে ডায়ালাসিস দেওয়া হয়। পাশাপাশি ১২ শতাংশ রোগীকে বিনামূল্যে ডায়লাইসিস সেবা দেওয়া হচ্ছে। রোগীদের সার্বক্ষণিক সেবাদানে একজন শিশু কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞসহ ৯ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারসহ আশপাশের জেলার মানুষ সেবা নিতে আসেন। তবে চাহিদার ১০ শতাংশ পূরণ করতে পারছি।
সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. আরিফ মো. রেজা যুগান্তরকে বলেন, ২০১৮ সালে চালু উপশহরের কেন্দ্রটি গত সপ্তাহে এখানে স্থানান্তর করা হয়েছে। নতুন এই হাসপাতালে বর্তমানে ১৮০ জন কিডনি রোগী নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন।
সিলেটের গোলাপগঞ্জ পৌরসভা বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (৫০)। এক বছর ধরে কিডনি সমস্যায় ভুগছেন। শনিবার ছোট ভাই আলী হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে ডায়ালাইসিস করাতে আসেন তিনি। আলী হোসেন বলেন, ভাইয়ের সপ্তাহে দুবার করে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। অন্য জায়গায় ডায়ালাইসিসে ৩ হাজার টাকার মতো লাগে। চিকিৎসার জন্য সহায়-সম্বল যা ছিল বিক্রি করতে হয়েছে। খোঁজ পাওয়ার পর এই হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাচ্ছেন। এখানে প্রতি ডায়ালাইসিসের জন্য ১ হাজার ৬০০ টাকা লাগে। সপ্তাহে ১০ হাজার ৫০ টাকায় ডায়ালাইজার সেট কিনতে হয়। প্রতি মাসে গড়ে ৩ হাজার টাকার টেস্ট, প্রতিবার হাসপাতালে যাতায়াতে ৬০০ টাকার ভাড়া এবং মাসে ৫ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। এছাড়াও মাঝে মাঝে রক্ত দিতে হয়।